শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৩ অপরাহ্ন

ক্যাসিনোর সিন্দুক ভরা ব্যাংকে টাকার আকাল

ক্যাসিনোর সিন্দুক ভরা ব্যাংকে টাকার আকাল

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানীর ক্যাসিনো-কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ অভিযানে সংশ্লিষ্টদের অফিস-বাড়ির সিন্দুক আর লকারে মিলছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। অনেকে ব্যাংকের কায়দায় ভল্ট বানিয়ে তাতে ভর্তি করে রেখেছে নগদ অর্থ আর স্বর্ণালঙ্কার। এমন সময় ব্যাংকগুলো ভুগছে তারল্য সংকটে। অবৈধ ভল্ট ভর্তি হলেও ব্যাংকের ভল্টগুলো খালি। টাকার অভাবে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। গত আগস্টে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার। তবে এ সময়ে ব্যাংক ভল্ট থেকে অর্থ বের হওয়ার হার ছিল সর্বোচ্চ পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ছাপানো মুদ্রার পরিমাণ ১২ লাখ ২৯ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। সব সময়ই ছাপানো নোটের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক

ব্যাংকগুলোর ভল্টে জমা থাকে। জনগণের হাতে থাকে সামান্য অর্থই। চলতি বছরে জুলাইয়ে ব্যাংকের বাইরে জনগণের হাতে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। আর মে মাসে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাইয়ে যেখানে মোট নোটের পরিমাণ বেড়েছে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ সেখানে জনগণের কাছে থাকা নোটের পরিমাণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। মে মাসে গ্রাহকের কাছে নোটের পরিমাণ বাড়ে ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। মোট নোটের সংখ্যা বাড়ে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ ছাপানো নোটের মধ্যে বেশিরভাগই জনগণের হাতে চলে গেছে। কিন্তু সাধারণত ব্যাংকে থাকা এবং ব্যাংকের বাইরে থাকা নোটের পরিমাণ বাড়ে প্রায় কাছাকাছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে যখন ঘুষ-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে পথ সুগম হয় তখন ব্যাংকের অর্থ মানুষের কাছে চলে যায়। মানি লন্ডারিং আইনের ফলে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে তার উৎস জানাতে হয়। কেউ অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা রাখলে তা ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থ দুষ্কৃতকারীদের কাছে থেকে যায়। এই অবৈধ অর্থ দিয়ে ডলার, ইউরো বা স্বর্ণ কিনে বাসা বা নিরাপদ জায়গায় রেখে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈধ উপার্জনের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের বিষয়ে বলেন, অনেক ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। তারল্য সংকট সৃষ্টির কারণের মধ্যে অন্যতম পাচার হয়ে যাওয়া। ব্যাংকের বাইরে টাকা চলে গেছে। সেই অর্থ কারও ঘরে আছে বা বিদেশে পাচার হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকের আমানত বাড়ছে না। চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে অর্থপাচারের বিষয়ে কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণে হয়েছে তার তথ্য এখনো জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের বাইরে অধিক পরিমাণে নোট চলে যাওয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসে মে মাসে। ওই মাসে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ব্যাংকের বাইরে চলে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা হয়। জনগণের হাতে অর্থ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকে টাকার সংকটের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকের নজরে আনেন বলে জানা গেছে।

ব্যাংকগুলোয় অর্থ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে গত বছর থেকে। সেই সংকট এখনো কাটেনি। ঋণ আমানত সীমা (এডিআর) বছর দুয়েকজুড়ে কখনো সীমার বাইরে কখনো সীমার কাছাকাছি রয়েছে। জণগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ বাড়াতে না পেরে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই। এ জন্য চলতি বছরের শুরু থেকে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার রেকর্ড পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৭ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। আগের বছরের আগস্টে যা ছিল ৯ লাখ ১০ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ওয়েবসাইটে ২০০৭-০৮ অর্থবছরের পর থেকে প্রতিমাসে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির চিত্র দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কোনো মাসে ঋণ বিরতণের বৃদ্ধির হার এত কম হয়নি। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম হয়েছে গত আগস্টে। জানুয়ারির পর থেকে প্রতি মাসেই ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির হার কমার রেকর্ড গড়েছে। জানুয়ারিতে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ১৩.২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১২.৫৪ শতাংশ। এরপর মার্চে ১২.৪২, এপ্রিলে ১২.০৭, মে ১২.১৬, জুনে ১১.২৯ শতাংশ এবং জুলাইয়ে ৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ১১.২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সীমা ছিল (এডিআর) ৮৩ শতাংশ। অধিকাংশ ব্যাংক এ সীমার কাছাকাছি থাকায় নতুন করে ঋণ বিতরণের সুযোগ ছিল না। এ জন্য ঋণ বিতরণ কমেছে। এ সীমা এবং ব্যাংকগুলোয় নগদ তারল্য না থাকায় ঋণ বিতরণ ব্যাপকহারে কমেছে। তিনি বলেন, ব্যাংকের বাইরে বিপুল পরিমাণ টাকা চলে যাওয়া মানে অর্থের অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে, মানি লন্ডারিং হচ্ছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিশেষ করে এর পরিমাণ বেশি হলে তা ব্যাংকে রাখার সুযোগ কম। ওই টাকা নগদ আকারে, কেউ ডলার বা ইউরো এবং স্বর্ণ কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়। মানুষের কাছে ব্যাপকহারে ক্যাশ টাকা জমে থাকার কারণে ব্যাংকে টাকা আসছে কম।

ঋণ বিতরণ কম হওয়ার বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট। টাকার অভাবে অনেক ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে গেছে। বড় বড় যেসব ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার মতো অর্থ আছে তারা ভালো গ্রাহক খোঁজার চেষ্টা করছে। ঋণ বিতরণে তারা অনেক সতর্ক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত মে মাসে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। এটি গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই মাসে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ব্যাংক ভল্ট থেকে জনগণের হাতে চলে যায়। তবে তারল্য পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877